ছোটগল্প - তার দেওয়া কাজল, লেখক কোয়েল তালুকদার

 ছোটগল্প -

তার দেওয়া কাজ

ছোটগল্প -  তার দেওয়া কাজ  একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি -- অতিথি রুমে আলো জ্বলছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলি, 'কে এসেছে, আলো জ্বলছে যে ঐ ঘরে।'  আমার স্ত্রী বলে, তোমার দেশের বাড়ি থেকে দুজন মানুষ এসেছে। সম্ভবত ওনারা স্বামী স্ত্রী।'  --- তাই। তুমি কী ওনাদের আগে দেখনি?  --- না।  মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি তোমার কী হই? আমি যখন বলি, আমি তোমার স্ত্রী  হই। তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'তুমি আমাদের রঞ্জনের বউ! ও মা, কত সুন্দর তুমি! তারপর আমাকে যত সব আদর করা শুরু করেছিল।'  আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই অতিথি রুমে যাই। দেখি, পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা ও একজন পুরুষ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার মুখ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ওঠে। ওনারও আমাকে চিনতে পারছিল না। আমার স্ত্রী মহিলাকে বলে, ইনি হচ্ছেন আপনাদের রঞ্জন, আপনাদের ছেলে।'  মহিলা আমার পরিচয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এবং বলে -- 'তুমি এত বড় হয়ে গেছ!'  মহিলা বলেন, তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। সেই ছোট বেলায় আমাকে দেখেছ। আমি তোমার ' জহুরা বুবু। মনে পড়ছে আমার কথা? মনে পড়ে কী আমাকে? সেই কত বছর আগের কথা।''  ফ্ল্যাশ ব্যাক। পঁচিশ বছর আগে।  ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। স্কুল থেকে বাড়িতে   ফিরলে আমাকে খেতে দিত -- হয় মা, না হয় জহুরা বুবু। জহুরা বুবু আমার জন্মের আগে আমাদের   বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল। সেই নাকি কোলে পিঠে আমাকে লালন পালন করেছে। আমাকে দেখে শুনে রেখেছে।  একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, জোহরা বুবু চোখে মোটা করে কাজল পরে আছে। আমি তার চোখের দিকে বিস্ময়ে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকি। জহুরা বুবু আমাকে বলে -- 'কী দেখছ তুমি?'  আমি আঙুল দিয়ে জহুরা বুবুর চোখ দুটো দেখাই।  জহুরা বুবু বলে ওঠে ---'ওরে আমার ভাইটা।'   বলেই তার চোখ থেকে আঙ্গুল দিয়ে কাজল মুছে মুছে আমার চোখে পরিয়ে দেয়। জহুরা বুবুর দেওয়া তার চোখের কাজল আমার চোখে এখন আর নেই। তা মুছে গেছে কবে।  একদিনের কথা মনে আছে। আমার খুব জ্বর এসেছিল। দু-তিন দিনেও জ্বর নামছিল না।  এই জহুরা বুবু মাকে কিছুতেই রাত জাগতে দেয়নি। সেই  একটানা চার রাত আমার সিয়রে বসে জেগে থেকেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। দুচোখের পাতা একটু সময়ের জন্য সে বন্ধ করেনি।  আমার শিশুকালে জহুরা বুবু কত যে সেবা যত্ন করেছে, কত যে বিরক্তি ও যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে সব কথা আমার মনে নেই। আমি শুধু আমার মার কাছে থেকে সে সব কথা পরে শুনেছি।  আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, এক বর্ষার দিনে  জহুরা বুবুর বিয়ে হয়ে যায়। মা বাবাই সমস্ত বন্দোবস্ত করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় দূরের এক গ্রামে।  আমার শুধু মনে আছে, শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় জহুরা বুবু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ফূঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নৌকায় উঠে সারা পথ নাকি সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল।  বিয়ে হয়ে যাবার পর জহুরা বুবু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত। তারপর তার সংসার ব্যস্ততায় খুব বেশি আসত না। তারপর  একদম না। তারপর চলে গেছে অনেক বছর।  জহুরা বুবু আস্তে আস্তে সবার কাছে বিস্মৃত হয়ে যায়।  এই বিস্মৃত জহুরা বুবু কে দেখে যতটুকু খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি বিষাদে মনটি ভরে উঠল। জহুরা বুবু কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। মনে হল, সে বড় ধরণের কোনো রোগে দুঃখে ভুগছে।  জহুরা বুবুই বলছিল, 'আমি তোমাদের বাড়ি থেকে ঠিকানা নিয়ে তোমার এখানে এসেছি। আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে মনে হয়। ওখানে  এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই অসহায় হয়ে তোমার এখানে চলে এলাম। এই ঢাকা শহরে আমাদের আপন কেউ নেই। তোমার কথা মনে হল।  তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।'  আমি জহুরা বুবু কে বলি, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখাব। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবে। জহুরা বুবু কিছু টাকা বের করে আমার হাতে দেয়। বলে, 'জানি না, কত খরচ হবে। তুমি এখান থেকে খরচ করবে।' আমি ঐ মুহুর্তে জহুরা বুবু কে কোনো করুণা করতে চাইনি। আমি তার হাত থেকে টাকা নিয়ে নেই।  রুমে এসে আমি আমার স্ত্রীকে বলি -- ' জানি, তোমাকে না বললেও তুমি ওনাদের জন্য অনেক করবে। তবুও বলছি, তুমি বিরক্ত হবে না।'   তোমাকে একটা কথা বলি -- 'এই জহুরা বুবু আমার বড় বোনের মতন, আমার মায়ের মতন। আমার সর্ব শরীরে ওনার মায়া, মমতা, আদর স্নেহ লেগে আছে।'  আমার ছলো ছলো চোখ দেখে, ও শুধু বলল, 'ওনাদের কোনও অসম্মান ও অবহেলা হবে না। তুমি দেখ।'  শহরের সবচেয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জহুরা বুবু কে দেখাই। ওনার সমস্ত কিছু চেক আপ করানো হয়। সব গুলো রিপোর্ট পেতে দুই তিন লেগে যায়। ইতোমধ্যে ঔষধ ও খেতে থাকে। সুন্দর চিকিৎসা পেয়ে জহুরা বুবুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।  একদিন রাতে টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, আমার খাওয়া দেখে জহুরা বুবু আমার স্ত্রীকে বলছিল, 'বউ মা, তুমি রঞ্জনকে এত ঝাল ভাত খাওয়াও কেন? ও তো ছোটবেলায় ঝালভাত খেত না। দুধ আর সর্বিকলা দিয়ে ভাত খেত। ও কোনো সময় নিজ হাত দিয়ে ভাত খেত না। চাচি আম্মা, না হয়‌ আমি তুলে খাওয়াতাম।'  আর একদিন আমার মাথার চুলে তেল নাই দেখে, আমার স্ত্রীকে বলছিল , 'বউ মা, তুমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দাও না কেন? সরিষার তেল নিয়ে আসো, আমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দেই।' এ রকম আরও অনেক কিছু ঐ অল্প কয়দিনে আমাকে পেতে হয়েছে।  ইতোমধ্যে সমস্ত রিপোর্ট গুলো পেয়ে যাই। জহুরা বুবু কে আবার  ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট সব দেখলেন। রিপোর্ট দেখে তাঁর মুখটি বিমর্ষ হয়ে উঠে। তিনি নতুন করে আরও ঔষুধ দিলেন। এবং ইংরেজিতে আমাকে বললেন-- 'আপনি ওনাদের বাইরে রেখে এসে আমার সাথে দেখা করুন।' আমি জহুরা বুবুকে বাইরে রেখে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করি।  ডাক্তার বললেন, ওনার লিউকেমিয়া ধরা পড়েছে। রক্তের ক্যান্সার। খুব বেশি হলে উনি তিন মাস বাঁচতে পারে। এই চিকিৎসা এখানে এখনও ঐ রকম নেই। খুব ব্যায়বহুল। আর করেও লাভ হবে না।  জহুরা বুবু তার স্বামীসহ আমার বাসায় আরো তিন দিন ছিল। আমি জহুরা বুবুকে বলি, 'ডাক্তার সাহেব তোমাকে তিন মাসের ঔষধ দিয়ে দিয়েছে। তুমি যদি ভালো না হও, তিন মাস পর আবার এস।'  যেদিন জহুরা বুবু চলে যাবে, সেদিন বুবুকে বলি, 'বুবু তুমি আমার চোখে একটু কাজল পরিয়ে দাও না!'   আমার স্ত্রীর কাছে কাজল ছিল। সে কাজল নিয়ে আসে। জহুরা বুবু আমার চোখে কাজল পরিয়ে দেয়। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। দেখি, জহুরা বুবু অঝোরে কাঁদছে।  তারপর আরও কত বছর চলে গেছে। শুনেছি অনেক আগেই জহুরা বুবু চলে গিয়েছেন  জীবন নদীর  ওপারে।  তার দেওয়া সেই কাজল এখন আর আমার চোখে নেই। তা কবে মুছে গিয়েছে!  ~ কোয়েল তালুকদার  ভালোবাসার গল্প , কাছে আসার গল্প , দুঃখে গল্প, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, স্ত্রীকে নিয়ে ভালোবাসার গল্প, এবং স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার বন্ধন নিয়ে গল্প গুলো শেয়ার করতে হলে আমার আইডিতে ইনবক্স করুন। ধন্যবাদ।   Md. Hamidul Islam

একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি -- অতিথি রুমে আলো জ্বলছে। আমি আমার স্ত্রীকে বলি, 'কে এসেছে, আলো জ্বলছে যে ঐ ঘরে।'

আমার স্ত্রী বলে, তোমার দেশের বাড়ি থেকে দুজন মানুষ এসেছে। সম্ভবত ওনারা স্বামী স্ত্রী।'

--- তাই। তুমি কী ওনাদের আগে দেখনি?

--- না।  মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি তোমার কী হই? আমি যখন বলি, আমি তোমার স্ত্রী  হই। তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'তুমি আমাদের রঞ্জনের বউ! ও মা, কত সুন্দর তুমি! তারপর আমাকে যত সব আদর করা শুরু করেছিল।'

আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই অতিথি রুমে যাই। দেখি, পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা ও একজন পুরুষ বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার মুখ ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ওঠে। ওনারও আমাকে চিনতে পারছিল না। আমার স্ত্রী মহিলাকে বলে, ইনি হচ্ছেন আপনাদের রঞ্জন, আপনাদের ছেলে।'

মহিলা আমার পরিচয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এবং বলে -- 'তুমি এত বড় হয়ে গেছ!'

মহিলা বলেন, তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। সেই ছোট বেলায় আমাকে দেখেছ। আমি তোমার ' জহুরা বুবু। মনে পড়ছে আমার কথা? মনে পড়ে কী আমাকে? সেই কত বছর আগের কথা।''

ফ্ল্যাশ ব্যাক। পঁচিশ বছর আগে।

ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। স্কুল থেকে বাড়িতে 

ফিরলে আমাকে খেতে দিত -- হয় মা, না হয় জহুরা বুবু। জহুরা বুবু আমার জন্মের আগে আমাদের 

বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল। সেই নাকি কোলে পিঠে আমাকে লালন পালন করেছে। আমাকে দেখে শুনে রেখেছে।

একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, জোহরা বুবু চোখে মোটা করে কাজল পরে আছে। আমি তার চোখের দিকে বিস্ময়ে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকি। জহুরা বুবু আমাকে বলে -- 'কী দেখছ তুমি?'

আমি আঙুল দিয়ে জহুরা বুবুর চোখ দুটো দেখাই।

জহুরা বুবু বলে ওঠে ---'ওরে আমার ভাইটা।' 

বলেই তার চোখ থেকে আঙ্গুল দিয়ে কাজল মুছে মুছে আমার চোখে পরিয়ে দেয়। জহুরা বুবুর দেওয়া তার চোখের কাজল আমার চোখে এখন আর নেই। তা মুছে গেছে কবে।

একদিনের কথা মনে আছে। আমার খুব জ্বর এসেছিল। দু-তিন দিনেও জ্বর নামছিল না।  এই জহুরা বুবু মাকে কিছুতেই রাত জাগতে দেয়নি। সেই  একটানা চার রাত আমার সিয়রে বসে জেগে থেকেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। দুচোখের পাতা একটু সময়ের জন্য সে বন্ধ করেনি।

আমার শিশুকালে জহুরা বুবু কত যে সেবা যত্ন করেছে, কত যে বিরক্তি ও যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সে সব কথা আমার মনে নেই। আমি শুধু আমার মার কাছে থেকে সে সব কথা পরে শুনেছি।

আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, এক বর্ষার দিনে  জহুরা বুবুর বিয়ে হয়ে যায়। মা বাবাই সমস্ত বন্দোবস্ত করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় দূরের এক গ্রামে।  আমার শুধু মনে আছে, শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় জহুরা বুবু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে ফূঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নৌকায় উঠে সারা পথ নাকি সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল।

বিয়ে হয়ে যাবার পর জহুরা বুবু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত। তারপর তার সংসার ব্যস্ততায় খুব বেশি আসত না। তারপর  একদম না। তারপর চলে গেছে অনেক বছর।  জহুরা বুবু আস্তে আস্তে সবার কাছে বিস্মৃত হয়ে যায়।

এই বিস্মৃত জহুরা বুবু কে দেখে যতটুকু খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি বিষাদে মনটি ভরে উঠল। জহুরা বুবু কেমন শীর্ণকায় হয়ে গেছে। চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। মনে হল, সে বড় ধরণের কোনো রোগে দুঃখে ভুগছে।

জহুরা বুবুই বলছিল, 'আমি তোমাদের বাড়ি থেকে ঠিকানা নিয়ে তোমার এখানে এসেছি। আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে মনে হয়। ওখানে  এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই অসহায় হয়ে তোমার এখানে চলে এলাম। এই ঢাকা শহরে আমাদের আপন কেউ নেই। তোমার কথা মনে হল।  তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।'

আমি জহুরা বুবু কে বলি, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে ভাল ডাক্তার দেখাব। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবে। জহুরা বুবু কিছু টাকা বের করে আমার হাতে দেয়। বলে, 'জানি না, কত খরচ হবে। তুমি এখান থেকে খরচ করবে।' আমি ঐ মুহুর্তে জহুরা বুবু কে কোনো করুণা করতে চাইনি। আমি তার হাত থেকে টাকা নিয়ে নেই।

রুমে এসে আমি আমার স্ত্রীকে বলি -- ' জানি, তোমাকে না বললেও তুমি ওনাদের জন্য অনেক করবে। তবুও বলছি, তুমি বিরক্ত হবে না।' 

তোমাকে একটা কথা বলি -- 'এই জহুরা বুবু আমার বড় বোনের মতন, আমার মায়ের মতন। আমার সর্ব শরীরে ওনার মায়া, মমতা, আদর স্নেহ লেগে আছে।'

আমার ছলো ছলো চোখ দেখে, ও শুধু বলল, 'ওনাদের কোনও অসম্মান ও অবহেলা হবে না। তুমি দেখ।'

শহরের সবচেয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জহুরা বুবু কে দেখাই। ওনার সমস্ত কিছু চেক আপ করানো হয়। সব গুলো রিপোর্ট পেতে দুই তিন লেগে যায়। ইতোমধ্যে ঔষধ ও খেতে থাকে। সুন্দর চিকিৎসা পেয়ে জহুরা বুবুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

একদিন রাতে টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, আমার খাওয়া দেখে জহুরা বুবু আমার স্ত্রীকে বলছিল, 'বউ মা, তুমি রঞ্জনকে এত ঝাল ভাত খাওয়াও কেন? ও তো ছোটবেলায় ঝালভাত খেত না। দুধ আর সর্বিকলা দিয়ে ভাত খেত। ও কোনো সময় নিজ হাত দিয়ে ভাত খেত না। চাচি আম্মা, না হয়‌ আমি তুলে খাওয়াতাম।'

আর একদিন আমার মাথার চুলে তেল নাই দেখে, আমার স্ত্রীকে বলছিল , 'বউ মা, তুমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দাও না কেন? সরিষার তেল নিয়ে আসো, আমি ওর মাথায় তেল দিয়ে দেই।' এ রকম আরও অনেক কিছু ঐ অল্প কয়দিনে আমাকে পেতে হয়েছে।

ইতোমধ্যে সমস্ত রিপোর্ট গুলো পেয়ে যাই। জহুরা বুবু কে আবার  ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট সব দেখলেন। রিপোর্ট দেখে তাঁর মুখটি বিমর্ষ হয়ে উঠে। তিনি নতুন করে আরও ঔষুধ দিলেন। এবং ইংরেজিতে আমাকে বললেন-- 'আপনি ওনাদের বাইরে রেখে এসে আমার সাথে দেখা করুন।' আমি জহুরা বুবুকে বাইরে রেখে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করি।

ডাক্তার বললেন, ওনার লিউকেমিয়া ধরা পড়েছে। রক্তের ক্যান্সার। খুব বেশি হলে উনি তিন মাস বাঁচতে পারে। এই চিকিৎসা এখানে এখনও ঐ রকম নেই। খুব ব্যায়বহুল। আর করেও লাভ হবে না।

জহুরা বুবু তার স্বামীসহ আমার বাসায় আরো তিন দিন ছিল। আমি জহুরা বুবুকে বলি, 'ডাক্তার সাহেব তোমাকে তিন মাসের ঔষধ দিয়ে দিয়েছে। তুমি যদি ভালো না হও, তিন মাস পর আবার এস।'

যেদিন জহুরা বুবু চলে যাবে, সেদিন বুবুকে বলি, 'বুবু তুমি আমার চোখে একটু কাজল পরিয়ে দাও না!' 

আমার স্ত্রীর কাছে কাজল ছিল। সে কাজল নিয়ে আসে। জহুরা বুবু আমার চোখে কাজল পরিয়ে দেয়। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। দেখি, জহুরা বুবু অঝোরে কাঁদছে।

তারপর আরও কত বছর চলে গেছে। শুনেছি অনেক আগেই জহুরা বুবু চলে গিয়েছেন  জীবন নদীর  ওপারে।  তার দেওয়া সেই কাজল এখন আর আমার চোখে নেই। তা কবে মুছে গিয়েছে!

~ কোয়েল তালুকদার

ভালোবাসার গল্প , কাছে আসার গল্প , দুঃখে গল্প, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, স্ত্রীকে নিয়ে ভালোবাসার গল্প, এবং স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার বন্ধন নিয়ে গল্প গুলো শেয়ার করতে হলে আমার আইডিতে ইনবক্স করুন। ধন্যবাদ। 

Md. Hamidul Islam

Post a Comment

1 Comments

  1. আমার লেখা গল্পটি আপনার ব্লগে পোস্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete